বসন্ত, তুমি চলে এসেছো?
সড়কে রাশি রাশি আগুন-লাল কৃষ্ণচূড়া দেখে মনে মনে প্রশ্ন করলো শীত। পাশ থেকে কোকিলের কুহু ডাকও শোনা গেল একবার। হলদে শাড়ি পড়া এক তরুনী হনহন করে হেঁটে গেলো পাশ দিয়ে । তার খোপায় গাঁদা ফুল। হয়তো প্রেমিকের কাছে ছুটছে উন্মুখ হয়ে। যেন তর সইছে না।
এক তরুনকে দেখা গেলো এলোমেলো হাঁটতে। উসকোখুসকো চুল। উদাসী মন। যেন বসন্ত তার কাছে বিলাপ হয়ে এসেছে। যেন সে ভাবছে ফেলে আসা কোনও এক বসন্ত দিনের কথা। হাতের সিগারেট নিজে নিজেই পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে তার। আশেপাশে কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। আনমনে হেঁটে চলেছে সে মহাকালের দিকে।
এবার চোখে পড়লো একটা যুগলের। খুনসুটি করছে আর হাঁটছে। ধীরে। ছেলেটির বাম হাত মাঝে মাঝে ছুঁয়ে দিচ্ছে মেয়েটির ডান হাত। আলতো করে। তারপর শিউরে উঠছে তারা দুজনেই। চোখে চোখ রেখে কখনোবা থমকে দাঁড়াচ্ছে কয়েক মুহূর্ত। তারপর আবার প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলছে খুব সন্তর্পণে।
ওরা প্রাণপণে চাইছে যেন সময়টা আটকে থাকুক স্থির হয়ে। পথটা হয়ে উঠুক দীর্ঘ থেকে আরো বেশি দীর্ঘতর। বসন্তটা থাকুক বারো মাস, বছর, অনন্তকাল ধরে।
মনটা খারাপ হয়ে গেল শীতের। এবার অতটা জেঁকে বসার আগেই তার ফেরার সময় হয়ে এসেছে। যাই যাই করতে হচ্ছে তাকে। চোখ পড়লো একটা পাতাঝরা গাছের দিকে। হালকা বাতাস বইছে। মন উদাস করা বাতাস। নিচে এক পাতাকুড়ানি। নীল চোখের কিশোরী। তার মনটাও কিছুটা উদাসীন। হয়তো পাতা ঝরার দিন শেষ হয়ে এলো বলে। হয়তো কুয়াশাচ্ছন্ন কোনও ভোরে শিশিরের প্রেমে পড়েছিল বলে। কিংবা বয়ঃসন্ধীর টানাপড়েন চলছে তার হৃদয়ের গহীনেও।
‘পৃথিবীর পুরোনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়, প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়…’ জীবনানন্দের একটা কবিতার লাইন মনে মনে আওড়ালো শীত। তারপর বললো-
: বসন্ত, তুমি চলে এসেছো তাহলে?
: হুম।
: আমি তাহলে যাই।
: আমি চিরকালের জন্য আসিনি, শীত। আমাকেও যেতে হবে।
: হুম। জানি। কেউ চিরকালের জন্য আসে না কখনো। তবু সবাই চিরকালই থাকতে চায়। আমি বরং এখন যাই।
তারপর শিশিরের শব্দের মতো বসন্ত বাতাসে মিলায়ে গেলো শীত।
আর আমি শীতের জ্যাকেট আলমারিতে বন্দী করে ছুটছি অফিসের দিকে। আমাকে আজ লিখতে হবে শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন বেদনা আর গাইতে হবে বসন্তের আগমনী গান। বিকেলে ভাষন দিতে হবে মৃত কবিদের আড্ডায়। যারা বসন্তের কবিতা লিখতে লিখতে স্বেচ্ছায় হয়েছিল আত্মঘাতি। যাদের মৃতদেহ চাপা পড়ে আছে কৃষ্ণচূড়া আর হলুদ গাঁদা ফুলে। সন্ধায় স্ত্রীকে নিয়ে মিশে যেতে হবে জনসমুদ্রে, মানুষ দেখবার জন্য।
কিন্ত আমি তো হাজার বছর ধরে মগ্ন হয়ে আছি জীবনানন্দে, ভাবছি-
“যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে
অথচ আমি যার মুখ কোনদিন দেখিনি,
সেই নারীর মতো
ফাল্গুন আকাশে অন্ধকার নিবিড় হয়ে উঠেছে।”
[বসন্তের প্রলাপ]
১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯
আদাবর, ঢাকা