ট্রেন থেকে নেমে বুকভরে একটা শ্বাস নিলাম। স্টেশনের একদিকে আদিগন্ত সবুজের সমারোহ। চোখ জুড়িয়ে গেল। মাঝখান দিয়ে একটা কাঁচা রাস্তা এঁকেবেকে গিয়েছে। বহুদূরের গ্রামে গিয়ে ঠেকেছে সেই রাস্তা।
আরেক দিকে ছোট্ট একটা মফশ্বল শহর। কিছুটা ঘনবসতি। স্টেশন ঘিরে গড়ে উঠেছে কিছু দোকানপাট। আছে ছোট্ট ছোট্ট কিছু চায়ের টং দোকান।
এক কাপ গরুর দুধের চা খাবো কিনা সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। দুধ চা খেলে আমার পেটে গ্যাস হয়। সবসময় কালো কফি বা লাল চা খাই আমি। এক কাপ খেলে কিছু হবে না বলে চায়ের অর্ডার দিলাম। ত্রিশোর্ধ্ব এক নারী চা বিক্রি করছেন। তিনি কিছুটা আনমনা হয়ে চায়ের কাপটা এগিয়ে দিলেন। তার চোখের নিচে কালি পড়েছে। মলিন মুখ। হয়তো আজকের সারাদিনের বেচাবিক্রি তেমন ভালো না। অন্যকোনও কারণও থাকতে পারে। সাংসারিক জীবনের নানা টানাপড়েন।
আমি অচেনা মানুষ। এতকিছু ভাবা উচিত হবে না ভেবে তার দিকে আরেকবার তাকালাম। এবার চোখ গিয়ে সোজা পড়লো কোমরের দিকে। শাড়িটা সরে গিয়ে পেটের কিয়দাংশ বের হয়ে আছে। একটা কালো দাগ। আগুনে পোড়া মনে হয়। খেটে খাওয়া গ্রামের নারীরা এমনই। শরীর নিয়ে অত রাখঢাক নাই। চোখটা সরিয়ে নিলাম দ্রুত। পাছে আবার খারাপ কিছু ভেবে বসে।
চা শেষ। পকেট থেকে একটা সিগারেট ধরালাম। চায়ের দাম তিন টাকা। পঞ্চাশ টাকার একটা নোট এগিয়ে দিতেই তিনি কৌতুহল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আড়চোখে। ভ্রুটা একটু কুঁচকে গেল মনে হয়। পাঁচ টাকা খরচ করে পঞ্চাশ টাকা! তিনি কি একটু রাগ করলেন? আমি হনহন করে রেল লাইন পার হয়ে হাঁটা ধরলাম দূর গ্রামের দিকে।
স্টেশনের নাম শান্তিপুর।
এমন নয় যে আমি অশান্তিতে আছি বলে শান্তি খুঁজতে বের হয়েছি। আমার বয়স প্রায় সাঁইত্রিশ। সার্টিফিকেট অনুযায়ী আটত্রিশ হবার কথা। সবার সার্টিফিকেট বয়স কমানো থাকে, আমার এক বছর বাড়িয়ে দিয়েছে। এই বয়সেই আমার মাথার প্রায় অর্ধেক চুল পেকে গেছে। হয়তো জিনগত কারণ। আমার মামাদের অল্প বয়সে চুল পাকা দেখেছি। আমি আধাপাকা চুল নিয়েই একটা ভাব ধরে থাকি। সাংবাদিকতা করি। কাঁচাপাকা চুল আমাকে গম্ভীর হতে সহায়তা করে। ফলে বিশ বছর আগের কেউ প্রথম দেখায় আমাকে চিনতে পারে না। একটু সময় লাগে।
তেমন কোনও অশান্তি নেই জীবনে। খাচ্ছি-দাচ্ছি-ঘুমাচ্ছি। স্ত্রীও চাকরী করেন। ঢাকা শহরে মোটামুটি ভালোই চলছে আমাদের জীবন। কিন্তু মাঝে মধ্যে মনটা হাহাকার করে। যখন একলা থাকি। আশেপাশে কোনও বন্ধু-সহকর্মী নেই। তখন বুকের ভেতরটা হাহাকার করে। ফেলে আসা জীবনের কথা ভাবি। পরিবার-বন্ধু-আত্মীয়-স্বজন, ছোটবেলার খেলার সাথী আর আমার স্মৃতির বিষাদ প্রেমিকারা। আহা তারা এখন কে কোথায় আছে, কে জানে?
কৈশরে বা তরুণ বয়সে এমন হতো, কোনও কোনও মেয়েকে প্রথম দেখাতেই ভালোবেসে ফেলতাম। তারপর কিছুদিনেই তা হারিয়ে যেত ঠিকই, কিন্তু তাদের অস্পষ্ট স্মৃতি এখনো মনে পড়ে। সেসব আসলে প্রেম ছিল না, ছিল ঘোর।
যাই হোক, আমি যে গ্রামের দিকে যাচ্ছি, সেখানে আমার এক বন্ধু থাকেন। বিশ বছর আগের বন্ধু। ওরা তখন বাবার চাকরী সূত্রে আমাদের গ্রামে থাকতো। ও ছিল আমার সমবয়সী। তার সঙ্গে আমার খুব ভাব ছিল। ওদের বাসায় খুব যেতাম। ওর একটা ছোট বোন ছিল। দেখতে ছিল পরীর মতো। আমি ওদের বাসায় যেতাম সন্ধ্যায়। আর প্রতিদিন ঘোর লাগা সন্ধ্যা পার করে বাড়ি ফিরতাম। আহা।
এই যে বিশ বছর পর আমি আমার বন্ধুর বাসায় যাচ্ছি, তার নেপথ্যেও হয়তো সেই ঘোর থাকতে পারে। আমি নিজেও কনফিউজ। কারণ মাস কয়েক আগে ফেসবুকে আমার সেই বন্ধুর সঙ্গে দেখা। তারপর নাম্বার বিনিময়। টুকটাক কথাবার্তা। ও গ্রামেই থাকে, গৃহস্থালী করে। আমাকে একবার ওর গ্রামে বেড়িয়ে যাবার আমন্ত্রণ জানালো। আমি রাজী হয়ে গেলাম।
কাঁচা সড়ক ধরে হাঁটতে ভালোই লাগছে। রাস্তায় ভ্যান চলে। কিন্তু আমি হাঁটার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সূর্যটা পশ্চিমের দিকে হেলে পড়েছে। লালচে আলো পড়েছে সবুজ খেতগুলোর ওপর। একটু একটু ঠান্ডা লাগছে। আমি হাঁটছি আর ভাবছি সেইসব ঘোরের কথা। কৈশরের সেই দিনগুলির কথা। উন্মাতাল প্রথম তারুণ্যের কথা। আহা।
একদিন সন্ধ্যায়। আমার সেই বন্ধুর বাসায় গিয়েছি। ওরা দুই ভাইবোন পড়তে বসেছে। কুপি জ্বালিয়ে। কুপিটা কার দিকে বেশি কাছে থাকবে তা নিয়ে দুই ভাইবোন টানাটানি করছিল। আর শেষে জ্বলন্ত কুপিটা ঢিল মেরেছিল ছোট বোনের দিকে, আমার সেই বন্ধু। কোমরে দাউদাউ করে আগুন লেগে গিয়েছিল তার বোনের, কেরোসিনে। আমি দৌড়ে গিয়ে নিভিয়ে ছিলাম। সে এক বিভৎস দৃশ্য। আগুনের ফোসকা। চিৎকার, চেঁচামেচি। আমি কষে একটা চড় লাগিয়েছিলাম আমার সেই বন্ধুর গালে। তারপর থেকে বন্ধুত্বে কিছু ভাটা পড়েছিল।
তারপর একদিন ওরা চলে গেল। বিশ বছর পর আমি ওর গ্রামে। আমি দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি কেউ একজন প্রবল আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। হয়তো আমার সেই বন্ধু। কিন্তু আমার চোখ তখনও পড়ে আছে পেছনে ফেলে আসা সেই চায়ের দোকানে। ত্রিশোর্ধ সেই নারীর কোমরের দিকে। পোড়া একটা কালো দাগে…
[কোমরের কালো দাগ]
নুরুজ্জামান লাবু
পান্থপথ, ঢাকা।
১১-১-২০১৯