বৈশাখ মাস। আজ কততম দিন মনে নাই। শেষের দিকে হবে হয়তো। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। ব্রহ্মপুত্র পাড়ে বইসা আছি। শহররক্ষা বাঁধরে কেন্দ্র কইরা যে পার্ক গইড়া উঠছে মমিসিং, সেই পার্কের কোণার দিকে।
আমার গায়ে জ্বর। চাদর দিয়া শরীরটা জড়ায়ে রাখছি ঠিকই, কিন্তু ঠান্ডা মানতেছে না। হালকা বাতাস বইতেছে আর মাঝে-মধ্যে ভিতর থিকা কাঁপুনি হইতেছে। বৃষ্টি ছিল, এখন নাই।
এইরকম জ্বর নিয়া তবু আইজ সকালে আমি ঢাকা থিকা মমিসিং আসছি। কারণ আছে। বলতেছি। সেই কারন শুনতে চাইলে একটু ধৈর্য্য ধরতে হবে।
সকালে যখন বাস থিকা মমিসিং নামলাম, দেখি দুইটা অটোরিকশা দাঁড়ায়ে আছে স্ট্যান্ডে। একজন আগ বাড়ায় আইসা বললো, ’স্যার চলেন, আপনি তো ব্রহ্মপূত্র নদীর পাড়ে যাইবাইন, তাই না?’
আমি একটু আশ্চর্য হইলাম বটে। অটোওয়ালা আমার গন্তব্য জানলো কিভাবে? কিন্তু একটুও বুঝতে দিলাম না। যেন সবকিছু স্বাভাবিক এমন ভাব কইরা কইলাম- হুম, চলো।
তো ব্রহ্মপুত্রের তীরে বইসা আছি। অপেক্ষায়। সুহাসিনী আসবে। আজকে তার সাদা শাড়ী পইড়া আসার কথা। স্লিভলেস ব্লাউজ। কপালে কালো টিপ থাকবে। খালি পায়ে।
কিন্তু এরই মধ্যে আজব একটা দৃশ্য চোখে পড়লো। নদীতে পানি তুলনামূলক কম। কিন্তু কম পানিতেই নৌকা নিয়া এক জেলে মাছ ধরতেছেন মনে হইলো। স্যুট-টাই পইড়া এক লোক লগি ঠেলতেছে। আমার দিকে তাকায়া চিৎকার কইরা উঠলো লোকটা।
বললো- হেই ম্যান, স্কচের গ্লাসে অশ্রু গিলে খাচ্ছে যে উদভ্রান্ত প্রেমিক, তাকে তুমি অবহেলা করো না প্রেম। নতুন কবিতার লাইন। কেমন হইছে?
আমি একটু পুলকিত হইলাম। শরীর কাঁপতেছে জ্বরে। এই সময়ে মাঝ নদীতে বৈঠা ঠেলতে ঠেলতে যদি কেউ প্রেমের কবিতা শোনায়, তা খারাপ লাগার কথা না। কিন্তু আমার তা ভালোও লাগতেছে না। আবার খারাপই বা লাগবে কেন? আমি কবিতা ভালোবাসি। লোকটা মেবি জানে।
তো জ্বরের ঘোরে আমি কিছু কথা বলবো। প্রলাপের মতো। কেউ কেউ এই কথারে সত্য ভাববে, কেউ মিথ্যা। জ্বরের ঘোরে প্রলাপে প্রলাপে কিছু বলার এইটা একটা সুবিধা। সত্যরে মিথ্যার মতো কইরা বলা যায় আবার মিথ্যারে সত্যের মতো কইরা।
আমি ব্রহ্মপূত্রের এই পাড়ে আসছি সুহাসিনীর লগে দেখা করতে। আমাদের শেষ দেখা হইছিল চৌদ্দ বছর আগে। এই চৌদ্দ বছর আমি যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্ত হইয়া জেলে ছিলাম। গতকালই মুক্তি পাইছি।
অবশ্য জন্মের পর থিকাই তো জেলের মধ্যে আছি। পৃথিবীটারেই আমার কাছে জেলখানা মনে হয়। ইচ্ছা মতো কিছু করা যায় না। নানারকম নিয়মের একটা শৃঙ্খল পইরা থাকতে হয়। আমার বাপ-দাদারাও এই জেলে বাস করছেন। এই জেলেই আমার জন্ম, জেল থিকা মুক্তির একটা পথ হইলো মৃত্যু। অবশ্য এই মুক্তি আমরা কেউ চাই না।
জেলে থাকতেই আমাদের ভালো লাগে, লাগতে হয় বা লাগাইতে হয়।
সুহাসিনীর সঙ্গে দেখা করতে আসছি। সুহাসিনীর আসল নামটা যেন কি? মনে পড়তেছে না। সুতপা বা সুপর্ণা এইরকম কিছু একটা হবে হয়তো। ষোল বছর আগে প্রথম দেখা হইছিল আমাদের, জর্মনগামী একটা ফ্লাইটে। সালটা দুই হাজার দুই বা তিন হবে হয়তো। এক্সাক্ট মনে করতে পারতেছি না। পাশের সিটে সুন্দরী একটা মাইয়া। আমি মনে মনে খুশি হইলাম বটে কিন্তু বুঝতে দিলাম না। সুহাসিনী বা সুতপা বা সুপর্ণা আমার দিকে আড়চোখে তাকায়া জিজ্ঞাসা করলো- ‘হোয়ার আর ইউ গোয়িং, স্যার?’ আমার চুল অর্ধেক পাকা, এজন্য প্রথম প্রথম অনেকেই আমাকে স্যার বলে।
‘আ’ম গোয়িং টু প্রাগ ভায়া বন টু মিট উইথ কাফকা, মাই ডুলাভাই (ব্রাদার ইন ল)।’ কাফকা আমার ডুলাভাই শুনে সে খুব মজা পেল মনে হলো। তারপর ঢলাঢলি করতে করতে আর ওয়াইন খাইতে খাইতে আমরা বনে গিয়া নামলাম। সুহাসিনী বা সুতপা বা সুপর্ণা আমারে বনে তার বাসায় যাবার অফার করলো। সে একটা মাস্টার্স প্রোগ্রামে আছে, একা বাসা নিয়া থাকে।
তো একবারের দাওয়াতে আমি তার বাসায় সাত দিন থাকলাম। ব্যপক মাস্তি, আড্ডা আর মজা হইলো। এক রুমের একটা ফ্ল্যাট। একটা বড় বারান্দা। বারান্দা থিকা রাইন নদী দেখা যায়।
প্রাগে আর যাওয়া হইলো না। অবশ্য সত্যি সত্যি আমি প্রাগে যাইতে চাইছিলাম কি না মনে নাই। সাত দিন পর ফিরলাম ঢাকায়। তারও ছয় মাস পর সুহাসিনী বা সুতপা বা সুপর্ণা আসলো মমিসিং। দাসপাড়ায় ওদের বাসা। আমি মমিসিং গেলাম, আমাদের দেখা হইলো ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে।
সুহাসিনী বা সুতপা বা সুপর্ণার তলপেট কিছুটা স্ফীত। জানাইলো, সে মা হতে চলতেছে, আমি বাপ। আমার মাথায় যেন আকাশ ভাইঙ্গা পড়লো। যেন বা ফণীর ঘূর্ণায়মান বায়ু আমারে একবার আকাশে তুইলা ছাইড়া দিল শুন্যের ওপরে। আমি কিছুই বুঝতে দিলাম না।
ও আমারে বাসায় নিয়া গেল। মা-মেয়ের সংসার। আত্মীয়-স্বজন বেশিরভাগ ওপার বাংলায়। একাত্তরে যুদ্ধের আগে আগে চইলা গেছে। ওনারা থাইকা গেছিলেন। সুহাসিনী বা সুতপা বা সুপর্ণার মায়েরে আমি প্রণাম জানাইলাম। উনি হাসিমুখে যত্ন করলেন, যেন বা আমি নতুন জামাই।
তারপর বিকেলে আবার ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে গেলাম। তখন বিকেলের ম্লান আলো পানির ওপরে সোনালী আভা ছড়াইতে ছিল। নদীর তখন ভরা যৌবন। থইথই পানি। এখনকার মরা গাঙের মতো না। পাড় দিয়া হাঁটতেছি। আমি একটু গম্ভীর মুখে বললাম- ‘এইটা কি ঠিক হইলো?’
আমার দিকে বিস্ময়ে তাকাইলো একবার সুহাসিনী বা সুতপা বা সুপর্ণা। তারপর একটা ঝপাৎ শব্দ হইলো। আমি নিচের দিকে তাকায়া ছিলাম, চোখ উপরে তুলে দেখি সুহাসিনী বা সুপর্ণা নাই। গভীর জলে কয়েকবার হাবুডুবু খাইলো, তারপর তলায়ে গেল। আমি থ হইয়া দাঁড়াইয়া ছিলাম। আশেপাশ থিকা লোকজন আসলো। নদীতে নৌকায় থাকা জেলেরা আসলো। পুলিশ আসলো। আমারে থানায় নেয়া হইলো। জিজ্ঞাসাবাদ। এবং পরদিন সকালে সুহাসিনী বা সুতপা বা সুপর্ণার লাশ উদ্ধার হইলো দুই-তিন কিলোমিটার ভাটিতে।
দুপরে বা বিকেলে সুহাসিনী বা সুতপা বা সুপর্ণার মা আসলেন থানায়। মামলা হইলো। তার আগে উনি আমারে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বাবা, তুমি কি ওরে ধাক্কা দিছ? আমি বিশ্বাস করতে পারতেছি না। তোমার সম্পর্কে আমারে বলছিল। আমার মন বলতেছে তুমি এই কাজ করো নাই। কিন্তু সবাই মামলা করতে বলতেছে।’
আমি মুখ তুলে ওনার দিকে তাকাইলাম। দেখি সুহাসিনী বা সুতপা বা সুপর্ণা হাসতেছে। আর বলতেছে, আমার মৃত্যুর জন্য তুমি দায়ি থাকবা। আমরা রাইন নদীর তীরে হাঁটতেছিলাম তখন, বনে।
‘আমার কিছু মনে নাই।’ বললাম আমি। উনি চলে গেলেন। তারপর পুলিশ আমারে রিমান্ডে নিল। মাইরের ভয় দেখাইয়া সব স্বীকার করতে কইলো। আমি শুধু বলতেছিলাম, ‘আমি ঠিক ধাক্কা দিছিলাম কি না আমার মনে নাই।’ আদালতেও একই কথা কইছি।
তারপর চৌদ্দ বছর আমি জেলে ছিলাম।
এইজন্য প্রতিবছর বৈশাখ মাসের মাঝামাঝিতে আমার গায়ে জ্বর আসে। জেলখানাতেও এইরকম হইছে। এই জ্বর নিয়া আমি তবু আজ সকালে মমিসিং আসছি।
সুহাসিনী বা সুতপা বা সুপর্ণার সঙ্গে আমার দেখা হবে। সাদা শাড়ী পইড়া আসার কথা তার। স্লিভলেস ব্লাউজ। কপালে টিপ, খালি পায়ে। আমি অপেক্ষা করতেছি। আমার জ্বর বাড়তেছে। সন্ধ্যা ঘনায়ে আসতেছে। বৃষ্টি আসবে মনে হইতেছে। বাতাসের তীব্রতা বাড়তেছে। জ্বরের ঘোরে হঠাৎ হঠাৎ মনে হইতেছে, আমি কি স্বপ্ন দেখতেছি? আমি কি মমিসিং সত্যি আসছি নাকি আমার আদাবরের বাসায় শুইয়া আছি? আজ তো শনিবার। আজ আমার ছুটির দিন। আমি কাল্পনিক জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছি না তো?
কিন্তু ওই যে সাদা শাড়ী দেখা যাইতেছে, ওই যে সুহাসিনী বা সুতপা বা সুপর্ণা আসতেছে।
[শনিবারের বিকেল, জ্বর অথবা ঘোর]
নুরুজ্জামান লাবু
আদাবর, ঢাকা।
তারিখ: 4 এপ্রিল 2019