খুলনায় এসে নামলাম। শীতের সকাল। আমার ধারনা ছিল, যতই দক্ষিণের বা সমুদ্রের দিকে আগাবো ততই শীত তুলনামূলক কম থাকবে। কিন্তু না, খুলনাতেও প্রচন্ড শীত, হাড় কাপানো।
ভোরে বাস থেকে নামতে গিয়েই হোঁচট খেলাম। সুপারভাইজারকে বলে রেখেছিলাম কেডিএতে নামবো। কানে হেডফোন দিয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলাম, রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজছিলো। বাস এসে দাঁড়ালো ফুলবাড়িয়া। কিছু বললাম না আর সুপারভাইজারকে ।
আলো তখনো পুরোপুরি ফোটেনি। একটা চায়ের দোকানে চা-টা খাচ্ছি । সময় কাটানো আরকি। রিস্ক ফ্রি হতে চাচ্ছিলাম। তা না হলে হয়তো দেখা যাবে অতিথি আপ্যায়নের জন্য ছিনতাইকারীরা সালাম জানাচ্ছেন । সেই সুযোগ তো দেয়া উচিত হবে না, না কি?
এর মধ্যেই বাসস্ট্যান্ডে দুজন পরিবহনকর্মীর প্রায় মারামারি শুরু করবার মতো অবস্থা । খিস্তি-খেউর করছেন, একজন আরেকজনের দিকে তেড়ে যাচ্ছেন । আমি ভাবলাম যাক ভালোই হলো। ওরা মনে হয় বুঝতে পেরেছে, আমি ক্রাইম রিপোর্টার, তাই নিজেরা মারামারি করে আমাকে স্বাগত জানাচ্ছে। না, শেষ পর্যন্ত মারামারি হলো না। লোকজন দুজনকে দুদিকে টেনে নিয়ে গেল।
আমি এবার চায়ের দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করলাম, চাচা, রয়েলের মোড় কতদূর? কিভাবে যাবো? চাচা বললেন, ও তো শহরে, অটোরিকশা বিশ-পঁচিশ টাকা নেবে। বুঝতে পারলাম আমি শহর থেকে একটু বাইরেই চলে এসেছি।
একটা অটোরিকশা ডাকলাম। ভাড়া চাইলো পঁয়ত্রিশ টাকা। বিশ টাকা দিয়ে শুরু করে ত্রিশ টাকায় ঠিক করলাম। অটোওয়ালা একটু সামনে এগিয়েই আরো যাত্রী নিলেন। এক হিন্দু বৌদি আর তার শাশুড়ি। হাতে প্যাথোলজির কাগজপত্র । ডাক্তার দেখাবেন। হাড় কাঁপানো শীত । কথাবার্তা তেমন হলো না। তারা নামলেন শেখ আবু নাসের মেডিকেলের সামনে। এর মধ্যে আরো কয়েকজন উঠলেন-নামলেন। এক প্রৌঢ়া ওঠার আগে আমার দিকে একটু তাকালেন, আমি আরেকটু চেপে আসলাম। উনিও নেমে গেলেন, কিন্তু আমার গন্তব্য আসছে না। মনে হলো ত্রিশ টাকার ভাড়ায় তো সত্তুর টাকার জায়গায় চলে আসলাম। হা হা ঢাকায় হলে এরকম ভাড়াই নিত কিংবা আরো বেশি।
রয়েল মোড়ে এসে উঠেছি রয়েল হোটেলেই। রিসিপশনে এক আংকেল ছিলেন। উনি বাড়িয়ে রাখা রুম ফেয়ার কর্পোরেট ডিসকাউন্ট দিলেন দুশো টাকা। শীতের সকাল, জার্নিতে ক্লান্ত শরীর, উঠে গেলাম। কারন একটু বিশ্রাম নিয়েই বেড়িয়ে পড়তে হবে।
রুম সার্ভিস বয় দেবাশীসকে বলে একটা ব্ল্যাক কফি মেরে দিলাম মানে পান করলাম। কারন এখন ঘুমালে দুপুরের আগে ঘুম ভাঙবে না, তাই ঘুমানো যাবে না। দেবাশিসকে বললাম দুটো খবরের কাগজ আনতে। একটু পর এসে জানালো ঢাকার পত্রিকা এখনো আসেনি। মনে পড়লো, ফ্রাই বছর বিশেক আগে দিনাজপুরের বীরগঞ্জে আমরা খবরের কাগজ পড়তাম বিকেলে। এখন তো ভোরেই আসার কথা, কি জানি ছেলেটা আমাকে বোকা বানালো কি না!
খুলনায় এসেছি ঠিক ঘুরতে নয়। নতুন বছরের প্রথম দিনই আমার এক সহকর্মী খুলনা প্রতিনিধি হেদায়েত ভাইকে বিতর্কিত ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ভোটের দিন রিটার্নিং কর্মকর্তার দেয়া ভুল তথ্য ছেপেছিলেন। পরে আবার কারেকশনও ছাপা হয়েছে । কিন্তু ভুল তথ্য দেয়ার জন্য রিটার্নিং কর্মকর্তার কিছু হয়নি, দায় এড়াতে উল্টো তিনিই মামলা করেছেন। সহকর্মী হেদায়েত ভাই এখন রিমান্ডে। কি আজব এক দেশ! গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের জন্য কি সুন্দর তাদের কালা কানুন!
অফিস থেকে আমাকে খুলনায় পাঠিয়েছে হেদায়েত ভাইয়ের পরিবারকে সহমর্মিতা জানাতে। এ টুকুন যেন তিনি আস্থা পান যে অফিস তার দুঃসময়ে পাশে আছে। আমার অফিস বাংলা ট্রিবিউন কর্তৃপক্ষ, আমার সম্পাদক, হেড অব নিউজের এই মানবিক এবং পেশাদার আচরণ আমাকে খুব আনন্দিত করে। মনে মন ভাবি, কখনো যদি আমিও এমন বিপদের মুখোমুখি হই, অফিস আমার পাশে থাকবে। এটাই আমার প্রেরণা। যেভাবে গণমাধ্যমের কন্ঠরোধের প্রবনতা শুরু হয়েছে তাতে বিপদের আশঙ্কা অমূলক নয়।
আর পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে কাজ করতে হলে এরকম বাঁধা বিপত্তি পেরিয়েই কাজ করতে হবে। কিন্তু গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বমূলক আচরন করছে তাতে তো প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই বস্তুনিষ্ঠ ও অনুসন্ধানী সংবাদ হুমকির মুখে। বাধ্যতামূলক উন্নয়ন সাংবাদিকতার নয়া জমানা আসতেছে…!!!
যাইহোক সকাল সকাল অনেক কথা হলো। সবাই ভালো থাকবেন। আর দোয়া করবেন হেদায়েত ভাই যেন দ্রুত মুক্তি পান।